।মোঃ শফিকুল ইসলাম।

(পর্ব- ২)

গত পর্বে তোমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারস্টেইট হাইওয়ে (যা সুপার হাইওয়ে নামে পরিচিত) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি। আশা করি, তোমরা বুঝতে পেরেছ আমেরিকা কেন দুনিয়ার উন্নততম একটি রাষ্ট্র। আসলে একটা দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা যদি এত উন্নত হয় তাহলে দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য উন্নত কেন হবে না?

যাইহোক, এই পর্বে তোমাদের রাস্তাঘাটের বেসিক কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো যাতে তোমরা রাস্তার নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারো।প্রথমেই আসি রাস্তার প্রকারভেদ নিয়ে। তোমাদের যদি জিজ্ঞাসা করি, রাস্তা কয় প্রকার?- তাহলে হয়তো উত্তর দিবে তিন প্রকার- পাকা রাস্তা, আধা পাকা (ইটের) রাস্তা আর কাঁচা রাস্তা।

উত্তর বাংলাদেশের জন্য সঠিক। কিন্তু উন্নত বিশ্বে কাঁচা আর আধাপাকা বলে কিছু নেই, সবই পাকা। তবে ব্যবহারের উদ্দেশ্য, নির্মাণ উপকরণ বা গুরুত্ব অনুসারে এগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয় এবং রাস্তার নামকরণও করা হয়।

হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমাদের দেশে বেশিরভাগ ঠিকানাই পিতার নাম ও গ্রাম/শহরের মাধ্যমে পরিচিত কিন্তু আমেরিকাতে সেটি রাস্তার নাম এবং বাসা নম্বরের মাধ্যমে পরিচিত।

আমেরিকায় মুলত তিনটি প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থায়নে রাস্তা নিয়ে কাজ করে।

১। ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশন (DOT)

২। ফেডারেল হাইওয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FHWA)

৩। অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব স্টেট হাইওয়ে অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি (AASHTO)

তন্মধ্যে, DOT হল আমাদের দেশের সড়ক ও জনপদ বিভাগের মত যারা সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সরাসরি নির্মাণ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের সকল কাজের তদারকি করে। আর FHWA মুলত DOT এর একটা অংশ যেটা শুধু হাইওয়ে নিয়ে কাজ করে, রাস্তা-ঘাটের অর্থায়ন করে এবং সরকারি অনেক জমির মালিক।

অপরপক্ষে, AASHTO অনেকটা নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠানের মত যেটা আসলে শিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করে থাকে, যেমন- নীতিমালা প্রণয়ন, নির্দেশিকা তৈরি, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

তো রাস্তার প্রকারভেদ একেক দেশে একেক রকম বা নামে হতে পারে যদিও মূল ধারণা একই। আর বাংলাদেশে আমেরিকান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় যেটা কানাডাতেও অনুসরণ করা হয়। সাধারণত, রাস্তাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়-

১। Freeways (মুক্তসড়ক)

২। Arterials (ধমনী)

৩। Collectors (সংগ্রাহক)

৪। Local Roads (স্থানীয় সড়ক)

বাংলা অর্থগুলো খুবই কাঠখোট্টা আর বেমানান মনে হচ্ছে, তাই না? আসলে শাব্দিক অর্থগুলো বরাবরই বেরসিক। তবে নামগুলোর সাথে বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। যেমন, ফ্রিওয়ে বা মুক্ত সড়ক হল যেখানে কোন বাধা বিপত্তিহীন ভাবে গাড়ি চলাচল করবে।

Arterials বা ধমনী যেমন হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে দেয় ঠিক তেমনি এই রাস্তাগুলো Collectors থেকে গাড়িকে Freeways গুলোতে পৌছে দেয়। Collectors বা সংগ্রাহক রাস্তাগুলো লোকাল রাস্তা থেকে গাড়ীকে আর্টেরিয়ালে পৌঁছে দেয়। আর তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে যেই ছোট রাস্তা গুলো যায় সেগুলোই লোকাল রোডস।

চিত্র-১: সানফ্রান্সিসকো বে এলাকায় ইন্টারস্টেইট ৮০ নামের ফ্রিওয়ে

FHWA ফ্রিওয়েকে Principal Arterial বলে আখ্যায়িত করে যার মধ্যে ইন্টারস্টেইট হাইওয়ে, অন্যান্য হাইওয়ে, টোল রোড (যেসব রাস্তা দিয়ে যেতে হলে ফি/টোল দিতে হয়) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে Limited Access Roads নামেও ডাকা হয়, কারণ, এখানে প্রবেশ করার রাস্তা অনেক কম এবং নিয়ন্ত্রিত।

আর এগুলোতে প্রবাশিধকার সংরক্ষণ করা হয় যেমনটা আগের পর্বে বলেছিলাম যে, এসব রাস্তায় পথচারী, বাইসাইকেল বা ধীরগতির বাহন নিষিদ্ধ। এসব রাস্তার বৈশিষ্ট্য যেমন আগের পর্বে উল্লেখ করেছি- কোন ইন্টারসেকশন নেই, ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার, কমপক্ষে ছয় লেন বিশিষ্ট ইত্যাদি।

বাংলাদেশে বসে এই রাস্তাগুলো কল্পনা করা কঠিন, কারণ, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন ফ্রিওয়ে তৈরি হয়নি তবে তোমরা যমুনা সেতুর উপরের রাস্তাটুকু অথবা গুলিস্তান-বঙ্গবাজার-যাত্রাবড়ি ফ্লাইওভার কল্পনা করতে পারো (যদিও ব্রিজ এবং ফ্লাইওভার ফ্রিওয়ে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা)।

ওখানে যেমন দুই পাশ থেকে কেউ উঠতে পারে না, আমেরিকার হাইওয়েগুলোও ঐভাবে দুপাশ থেকে দেয়াল বা বেড়া দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা থাকে। শুধু সুনির্দিষ্ট কিছু রাস্তার (এদেরকে র‍্যাম্প/Ramp বলে) মাধ্যমে হাইওয়েতে ওঠা যায়, বাকি অংশ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কেউ হেঁটে গিয়ে একটু ঘুরে দেখে আসবে তারও কোন উপায় নেই।

হাইওয়ে/ফ্রিওয়ে ব্যতীত অন্যান্য বড় রাস্তাগুলোকে FHWA মাইনর আর্টেরিয়াল বলে যেগুলো ট্রাফিক সিগন্যাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত। এতে সবধরনের যানবাহন আর মানুষের প্রবেশাধিকার আছে।

পথচারীদের জন্য ফুটপাথ আর বাইসাইকেলের জন্য বেশিচরভাগ ক্ষেত্রে আলাদা লেন থাকে। কমপক্ষে চারলেন বিশিষ্ট এই রাস্তাগুলো বেশীরভাগ সময়েই মাঝখানে ব্যারিয়ার (রেইজড মিডিয়ান বলে) দিয়ে আলাদা করা থাকে। এদের সাথে দুই পাশে যুক্ত থাকে কালেক্টর রাস্তাগুলো। আর এই আর্টেরিয়ালের সমাপ্তি ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাইওয়েতে গিয়ে।

অনেকটা বড় নদীগুলো যেমন ছোট নদী থেকে পানি নিয়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের দেশে যেসব রাস্তাগুলোকে আমরা হাইওয়ে বলে থাকি আমেরিকার প্রেক্ষাপটে সেগুলোকে বড়জোর মাইনর আর্টেরিয়াল বলা যায়। 

চিত্র-২: আমেরিকার একটা টিপিক্যাল আর্টেরিয়াল রোড দেখতে অনেকটা এরকম

কালেক্টর রোড আমাদের দেশের ছোটনদীর মত, যারা পানি/গাড়ি নিয়ে বড় নদীতে/আর্টেরিয়ালে বিলীন হয়ে যায়। এগুলো লোকাল রোড থেকে একটু বড়- দুই বা চার লেন বিশিষ্ট হয়ে থাকে। আর্টেরিয়ালের কিছু কিছু ফ্যাসিলিটি যেমন, বাইক লেন, ফুটপাথ ইত্যাদি কালেক্টরে থাকতে পারে।

বেশিরভাগই সিগনালাইজড, মাঝখানে উঁচু ডিভাইডার থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। মাঝে মধ্যে মাঝখানের লেন ডিভাইডার এবং টার্নিং লেন উভয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রেইজড মিডিয়ান না থাকলে শুধু হলুদ রঙের দাগ কাটা থাকে। এদের দুপাশে লোকাল রোড যুক্ত থাকে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ রাস্তাগুলোকে কালেক্টরের পর্যায়ে ফেলা যায়। কালেক্টর রোডকে অনেক জায়গায় ডিস্ট্রিবিউটর (Distributor) রোডও বলে কারণ রাস্তাগুলো যেমন লোকাল রোড থেকে ভেহিকল কালেক্ট করে তেমনি আর্টেরিয়ালের ভেহিকলগুলো বিতরণও করে।

সড়ক ব্যবস্থার সব চেয়ে ছোট ইউনিট হল- লোকাল রোড। তোমার বাড়ি থেকে বের হয়েই যে রাস্তায় পরো সেটাই হল- লোকাল রোড। ট্রাফিক সিগন্যাল বিহীন আর দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট এই রাস্তাগুলোতে আর্টেরিয়াল বা কালেক্টরের বেশীরভাগ সুবিধাই থাকে না।

এদেরকে আমাদের নদী ব্যবস্থায় ছোট খাল-বিলের সাথে তুলনা করতে পারি। এরা শুধু গাড়িগুলোকে বাড়ি থেকে কালেক্টর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এগুলোকে আমাদের দেশের ঢাকা শহরের গলির সাথেও তুলনা করা যায়।

আমেরিকার লোকাল রোডের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এগুলোর কোন আউটলেট নেই, অর্থাৎ, এগুলো দিয়ে কেবল বাসায় যাওয়া যাবে অথবা বাসা থেকে বের হয়ে আসা যাবে। একদিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বের হবার কোন উপায় নেই। যে রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হবে সেদিক দিয়েই বের হতে হবে।

চিত্র-৩: লোকাল রোড

আশাকরি, ইতিমধ্যেই তোমাদের মাথার মধ্যে চার প্রকারের রাস্তা মারামারি শুরু করে দিয়েছে। এখন সব ভুলে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার পড়। তোমাদের বোঝার সুবিধার্থে নিচের একটা ছবিতে সবগুলো রোড একসাথে দিলাম। হলুদ রঙের রাস্তাগুলো হল প্রিন্সিপ্যাল আর্টেরিয়াল বা ফ্রিওয়ে এবং মাইনর আর্টেরিয়াল বা শুধু আর্টেরিয়াল।

এর মধ্যে বেশি মোটা আর ২৮৫ নং রাস্তাটি হল ফ্রিওয়ে আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইন্টারস্টেট-২৮৫। এরপর অপেক্ষাকৃত কম মোটা হলুদ রঙয়ের ১০, ১৫৪, ২৭৮ নং লেখা রাস্তাগুলো হল মাইনর আর্টেরিয়াল। অতঃপর সাদা রঙয়ের নম্বর বিহীন রাস্তাগুলো হল কালেক্টর আর লোকাল রোড।

বেশি মোটাগুলো হল কালেক্টর আর চিকনগুলো হল লোকাল। আর নীল রঙের মাঝে সাদা বাড়ি চিহ্ন হল আমার বাসা। আশা করি, তোমরা বাসা চিনে আসতে পারবে।

চিত্র-৪

এতক্ষণে, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো রাস্তার প্রকারভেদের সাথে গতি বা Access এর সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেমন রাস্তার দুরত্ব বাসা থেকে যত বেশি তত বেশি গতিসম্পন্ন রাস্তা পাওয়া যাবে। নিচের গ্রাফে সেটাই বোঝানো হয়েছে।

চিত্র-৫

গত পর্বে প্রশ্ন করেছিলাম, দুইটি হাইওয়ে পরস্পর ক্রস করলে গাড়িগুলো গতিবেগ ধরে রেখে কীভাবে নিরাপদে রাস্তা পরিবর্তন করবে? নিচের ছবি দেখলে আশা করি উত্তর পেয়ে যাবে।

চিত্র-৬

দেখা হবে আবার পরের পর্বে ইনশাআল্লাহ। সবাই ভালো থেকো।

 

মে-জুন ২০১৮।বর্ষ ৪।সংখ্যা ১

 

 

 

পিথাগোরাসের ত্রয়ী

রোজার উপকারিতা

মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ

উইন্ড টারবাইনের গল্প

মস্তিষ্ক দখল

জার্নি টু দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

জার্নি টু দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

বিপজ্জনক ভাইরাসেরা

 

ছোট ম্যাজেলানিক ক্লাউড

 

চিনে রাখি অসুখগুলি

মহাশূন্যে বসবাস

বাদুড়ের অজানা অধ্যায়

শ্বাস-প্রশ্বাসের গল্প

সৌরজগতের জলাধার

ন্যানো প্রযুক্তির ঘরে

ফুটবলে বিজ্ঞানঃ টেলস্টার ১৮