।মোঃ মোকারম হোসেন।
উদ্ভিদ ও প্রাণি উভয়ের অপরিহার্য উপাদান হল কার্বন। প্রোটিনের প্রায় অর্ধেক ভাগ আর সেলুলোজের শতকরা প্রায় চুয়াল্লিশ ভাগই কার্বন দিয়ে গঠিত। এই কার্বন জীবে জটিল অংশ হিসেবে থাকে। এই কার্বনের বেশির ভাগ অংশই স্থায়ী । তবে অল্প কিছু অংশ অস্থায়ী তথা তেজস্ক্রিয়।
কোনো জৈব বস্তুতে এই তেজস্ক্রিয় কার্বনের পরিমাণ হিসাব করে তার বয়স নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় কার্বন ডেটিং সংক্ষেপে শুধু কার্বন ডেটিং। তাহলে জানা দরকার কিভাবে এই পদ্ধতি কাজ করে।
কার্বন-১৪
কার্বনের জমজ ভাই সম্পর্কে অনেকেই জানে না। সূর্য থেকে আসা উচ্চ শক্তির মহাজাগতিক রশ্মি অনবরত আমাদের গ্রহে আছড়ে পড়ছে। নিউট্রন সমৃদ্ধ এমন রশ্মি বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরি করে কার্বন-১৪ বা সি-১৪, যা কার্বন-১২ এর একটি আইসোটোপ।
একটি পরমাণু ও তার আইসোটোপ এর ইলেক্ট্রিক ধর্ম একই কিন্তু ভৌত ধর্ম ভিন্ন। কারণ উভয় পরমাণুর ইলেক্ট্রন ও প্রোটন সংখ্যা একই হলেও নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন। কার্বন-১৪ এর বিশেষ ধর্ম হলো অস্থায়িতা বা তেজস্ক্রিয়তা। যার কারণে এটি বিভিন্ন কণা বিকিরিত করে ক্ষয় হয়।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মূলনীতি
তেজস্ক্রিয় কার্বন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তেজস্ক্রিয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। এই তেজস্ক্রিয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদ কর্তৃক গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে তৃণভোজী প্রাণিতে সঞ্চারিত হয়। অতঃপর, এই তৃণভোজী প্রাণি মাংসাশী অথবা সর্বভূক প্রাণিতে গৃহীত কার্বনকে স্থানান্তর করে।
বায়ুমণ্ডলের প্রত্যেক জীবের গ্রহণকৃত কার্বনের অধিকাংশই কার্বন-১২, সামান্য অংশ কার্বন-১৪। একটি প্রাণি কার্বন গ্রহণ করে আবার শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে একে নির্গত করে।
কার্বন-১৪ পরমাণুর উৎপাদন, গ্রহণ এবং ত্যাগ এমন ভাবে ঘটে যেন পরিবেশ বা প্রাণিতে কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকে (যদিও পরিবেশ ও জীব থেকে জীবে কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর পরিমাণ ভিন্ন হয়) ।
সুতরাং কার্বন ডেটিং এর মূল উপপাদ্য বিষয় হলোঃ কার্বনের চক্রাকার লেনদেন সত্ত্বেও একটি জীবন্ত সত্তায় পরিবেশের মতই কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকবে।
যাইহোক, যখন একটি জীব মৃত্যুবরণ করে, সে আর কার্বন গ্রহণ করতে পারে না। তখন কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয় হওয়ায় ক্ষয় হতে শুরু করে কিন্তু কার্বন-১২ এর ক্ষয় হয় না। তাই কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত পর্যায়ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে।
সময় যত যেতে থাকে অনুপাত ততই কমতে থাকে। আর এই অনুপাত প্রত্নতাত্ত্বিকদের বয়স নির্ধারণে সাহায্য করে। নিচের সমীকরণ ব্যবহার করে খুব সহজে বয়সের হিসেবটি করা হয়।
N=N0ⅇ(-λt) ————(১)
এই সমীকরণটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ক্ষয় নির্দেশ করে। এখানে, N0 = মৃত্যুর সময় জীবে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সংখ্যা ( t=0) বা প্রাথমিক পরমাণুর সংখ্যা। N= বর্তমানে বা ক্ষয় হওয়ার পরে অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সংখ্যা। N এর পরিমাণ বের করা অনেক সহজ।
বিটা কাউন্টার বা মাস এক্সিলারেটর স্পেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করে নমুনাতে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সংখ্যা সহজে বের করা যায়। λ হল ক্ষয় ধ্রুবক । কার্বন-১৪ এর জন্য এর মান ৮২৬৭। আর t হল বয়স বা অতিবাহিত সময় ।
এখন আলোচনা করা যাক, N0 কিভাবে নির্ণয় করা হয়।
আমরা পূর্বেই জেনেছি, প্রত্যেক জীবের জন্য সবসময় পরিবেশে কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত একই থাকে। এই অনুপাতকে আমরা x ধরে নেই। এই অনুপাতের মান জানা।
X= ( কার্বন-১৪ এর সংখ্যা ) ⁄ (কার্বন-১২) এর সংখ্যা
এখানে মানে N0 । আর নমুনা জীবে কার্বন-১২ এর সংখ্যা বিটা কাউন্টার বা মাস এক্সিলারেটর স্পেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করে নির্ণয় করা যায়। তাহলে এই সমীকরণ থেকে সহজেই N0 এর মান বের করা যাবে।
সমীকরণ-১ কে পুনর্বিন্যাস করলে পাওয়া যায়,
t=8267. loge(N0/N) years
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা
কিছু মৌলিক ত্রুটির কারণে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। এই পদ্ধতির মূলনীতি ত্রুটি যুক্ত। এর মূলনীতি শুধুমাত্র একটি অনুমান, সত্য নয়। পরিবেশে কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকে না। কারণ-
১। শিল্পবিপ্লব: শিল্প টিকেই আছে জীবন্ত জীবাশ্মকে (কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল) ব্যবহার করে। এসব পুড়িয়ে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড কার্বন-১২ থেকে তৈরি হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে।
এতে কার্বন-১২ এর পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে বেড়ে গিয়ে কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির ব্যবহারে কোন নমুনার বয়স বাস্তবিকের চেয়ে বেশী হয়ে যাবে।
২। নিউক্লিয়ার মরণাস্ত্র: অপরদিকে প্রচুর পরিমাণ নিউক্লিয়ার মরণাস্ত্র পরীক্ষার কারণে বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ এর পরিমাণ ভয়ঙ্কর হারে বেড়েই চলছে। ফলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহারে কোন নমুনার বয়স বাস্তবিকের চেয়ে কম হয়ে যাবে।
চিত্র-৩: অনিয়ন্ত্রিত কার্বন-১২ নিঃসরণ
বর্তমানে, বর্ধিত বা হ্রাসকৃত কার্বন-১৪ পরমাণুর বিচ্যুতির জ্ঞানকে ব্যবহার করে নির্ণীত আপাত মান থেকে ভুলের পরিমাণ যোগ বা বিয়োগ করে কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নমুনার প্রকৃত বয়স পাওয়া যেতে পারে।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
সমীকরণ-১-এ কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অর্ধায়ু (কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের মুল অংশ থেকে অর্ধেক ক্ষয় হতে অতিবাহিত সময়) থেকে ক্ষয় ধ্রুবক λ পাওয়া যায়। কার্বন-১৪ পরমাণুর অর্ধায়ুর মান ৫,৩৭০ বছর। অতএব, এক-চতুর্থাংশ ও এক-অষ্টমাংশ হতে সময় লাগবে যথাক্রমে ১০,৭৪০ ও ১৬,১১০ বছর।
এভাবে কমতে কমতে ৫০,০০০ বছর পরে কার্বন-১৪ এর পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায় বা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না।
তাই বলা যায়, কার্বন ডেটিং পদ্ধতি প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। এর মাঝে মৌলিক ত্রুটিসহ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৩
—
No Comment