।মুজতাহিদ আকোন।
লেকচারার , ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট, পেনসেলভিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাষ্ট্র)
সাবেক সহযোগী সম্পাদক, ব্যাপন কিশোর বিজ্ঞান সাময়িকী
হিগস বোসন কী, এর অস্তিত্ব সম্পর্কে কীভাবে আমরা এত নিশ্চিত হলাম, কেনই বা আমরা একে খুঁজে পেতে এত মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম– এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে কণা-পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্যান্য কণা সম্পর্কে আমাদের সবার আগে জানা দরকার।
আমাদের জানা-শোনা মৌলিক কণার সংখ্যা খুব বেশি নয় – নেহায়েৎ হাতে গোনা। কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক কণা থাকতে পারে, যেগুলো এখনও আমাদের অজানা।
কণার প্রকৃতি
প্রতিটি মৌলিক কণার নির্দিষ্ট ভর ও স্পিন (ঘূর্ণন) থাকার পাশাপাশি এটি অন্য কণার উপর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। কোন কণার এরকম বৈশিষ্ট্যসূচক ধর্মগুলো জেনে ফেললে– এটা কোন ধরনের কণা– তা আমরা সহজেই বলতে পারি।
প্রশ্ন আসতে পারে– কেন একই ধরনের প্রতিটি কণার (যেমন- ইলেকট্রনের যেকোন কণা) প্রত্যেকটির ভর, স্পিন বা মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতি একই রকম হবে? এর কারণ হল, এরা প্রত্যেকে একই ফিল্ডের উদ্দীপন বা কম্পন থেকে সৃষ্টি হয়।
ফিল্ড কিংবা কণা– এদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল – কণা বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়? – ফার্মিওন নাকি বোসন? আগেই জেনেছি, ফার্মিওন হল পদার্থ সৃষ্টিকারী কণা। পরমাণু থেকে নানান রকমের ভৌত কাঠামো– সবই ফার্মিওন দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ ফার্মিওন স্থান (space) সৃষ্টির জন্য দায়ী।
আমরা জেনেছি, বোসন কণাগুলো একটির উপর আরেকটি আরোহণ করে একটি অনুভূতি গ্রাহ্য বল তৈরি করতে পারে। মহাকর্ষ, তড়িৎচৌম্বকত্ব, শক্তিশালী এবং দুর্বল বল – অর্থাৎ যে মৌলিক বলগুলোর সবই বোসন থেকে তৈরি।
প্রকৃতিগত দিক থেকে ফার্মিওনকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়; কোয়ার্ক এবং লেপটন। কোয়ার্ক এক ধরনের ফার্মিওন যা সবল নিউক্লিয় বলের (strong nuclear force) প্রতি সংবেদনশীল। গ্লুয়ন নামক একটি মৌলিক কণা এই বল বহন করে।
অপরদিকে, লেপটন নামক ফার্মিওন সবল নিউক্লিয় বল সংবেদী নয়। লেপটন এবং ফার্মিওন – উভয়ের দলেই আবার একাধিক মৌলিক কণিকা রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। বোসনেরও দুটি ভাগ আছে। কিন্তু এখানে একটি বড় রকমের ভারসাম্যহীনতাও রয়েছে।
আমরা প্রায় যতগুলো বোসনকে চিনি তার সবই গেজ বোসন। এ বোসনগুলো বল বহন করতে পারে। গেজ বোসন বলতে সে কণাগুলোকেই বোঝায় যেগুলো মহাকর্ষ, তড়িচ্চৌম্বকত্ব, দুর্বল এবং সবল নিউক্লিয় বলকে বহন করে।
বোসনের অপর রকমফেরটি হল হিগস বোসন। অসাধারণ কিছু যুক্তি বিবেচনায় এটি স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
কণার ঘূর্ণন
প্রতিটি মৌলিক কণা এক ধরনের স্বভাবসুলভ স্পিন (ঘূর্ণন) প্রদর্শন করে। এদের কোন আকার নেই। আকারবিহীন কণাগুলো সর্বদা ঘূর্ণনশীল এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক এবং বিশুদ্ধ ধর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কণার ঘূর্ণন পরিমাপের একটি মৌলিক একক হল প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। প্রখ্যাত জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্ক ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পথপ্রদর্শকদের মধ্যে অন্যতম। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক এককটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব তারই।
বোসনগুলোর স্পিন সর্বদা পূর্ণসংখ্যা হয়। যেমন- শূন্য, এক, দুই, তিন ইত্যাদি। হিগস-বোসনের স্পিন সংখ্যা শূন্য। অপরদিকে, গেজ বোসনের স্পিন সংখ্যা ১। উদাহরণস্বরূপ, ফোটন, গ্লুওন – এদের স্পিন সংখ্যা ১। ব্যতিক্রম কেবল গ্র্যাভিটন। এর স্পিন সংখ্যা দুই।
আগেই বলেছি, মহাকর্ষ বলবাহী কণার নাম গ্র্যাভিটন। মহাকর্ষ সব সময়ই একটু অন্যরকম আচরণ করতে পছন্দ করে। মহাকর্ষ স্থান-কালের বৈশিষ্ট্য বহন করে। আইনস্টাইনের দূরদৃষ্টি অনুসারে, হয়তো এটাই মহাকর্ষের নানা অদ্ভূত আচরণের অন্যতম কারণ।
অপরদিকে ফার্মিওনের স্পিন সংখ্যা পূর্ণসংখ্যার থেকে ½ বেশি হয়ে থাকে। অধিকাংশক্ষেত্রে এর মান ½। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ফার্মিওন ছাড়াও প্রায় সব মৌলিক ফার্মিওনের স্পিন সংখ্যা ঠিক ১/২। এর মধ্যে ইলেক্ট্রন, নিউট্রিনো এবং কোয়ার্ক অন্তর্ভুক্ত। একারণেই, একটি ফোটনের সমপরিমাণ ঘূর্ণনের জন্য ২ টি ইলেকট্রনের প্রয়োজন হয়।
পরমাণুর গভীরে
রসায়নের প্রধান গাঠনিক একক হল পরমাণু (atom)। পৃথক পৃথক পরমাণু একত্রিত হয়ে রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে। কিন্তু পরমাণু মৌলিক কণা নয়। এটি আরো ক্ষুদ্র কতগুলো কণার সমন্বয়ে গঠিত। পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত ঘন এবং মজবুত অংশটির নাম নিউক্লিয়াস।
পরমাণুর বাইরের অংশে রয়েছে ইলেকট্রনের আবাস। এরা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে এর চারদিক প্রদক্ষিণ করে। নিউক্লিয়াস মৌলিক কণা নয়। একটি নিউক্লিয়াস পরিবর্তিত হয়ে আরেকটি নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে পারে। একে তেজস্ক্রিয়তা বলে।
যেমন- ইউরেনিয়াম আলফা কণা নিঃসরণ করে থোরিয়াম নাম তুলনামূলক হালকা মৌলে পরিণত হতে পারে। একটি নিউক্লিয়াস যে আরেকটি নিউক্লিয়াসের পরিণত হতে পারে অথবা পরিবর্তিত নিউক্লিয়াসটি আবার আগের রূপে ফিরে যেতে পারে এ ব্যাপারে বিংশ শতাব্দীর আগে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না।
এমন ঘটনার মূল কারণ হল ক্ষুদ্রতর আরও কিছু কণার সমন্বয়ে নিউক্লিয়াস গঠিত হয় যাদের আমরা নিউক্লিয়ন বলি। নিউক্লিয়ন বলতে মূলত প্রোটন আর নিউট্রনকে বোঝানো হয়। প্রতিটি কণার সাথে বৈদ্যুতিক আধান (Electric Charge) বিজড়িত। প্রোটন হল ধনাত্মক আধানযুক্ত কণা। আর ইলেকট্রন হল ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণা।
পরবর্তীতে প্রোটনের প্রায় সমভরশিষ্ট আরেকটি কণা আবিষ্কৃত হয়। এটি খুঁজে পেতে তুলনামূলক বেশি বেগ পাওয়ার অন্যতম কারণ হল এটি বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ (neutral)। একারণে এর নাম দেয়া হয়েছে নিউট্রন। প্রোটন ও নিউট্রনকে নিউক্লিয়াসের মধ্যে একত্রে বেঁধে রাখার জন্য নিউক্লিয় বল ভূমিকা পালন করে।
ইলেকট্রনগুলো তড়িৎচৌম্বকত্বের কারণে নিউক্লিয়াসের সাথে আটকে থাকে। ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটনের দিকে আকর্ষণ অনুভব করে। বিদ্যুতের মৌলিক ধর্ম দিয়ে এ ঘটনাটি ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধর্ম বলে, বিপরীত আধান সর্বদা পরস্পরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে।
আগে মনে করা হতো, প্রতিটি নিউক্লিয়াস আলাদা ধরনের। কিন্তু এখন আমরা জানি, এরা কেবল প্রোটন আর নিউট্রনের বিভিন্ন অনুপাতে সংমিশ্রণ ছাড়া কিছুই নয়। একেক নিউক্লিয়াস একেক পরিমাণ নিউক্লিয়নের সমাবেশ মাত্র।
ভর ও শক্তি
প্রোটনের ভর পরিমাপের জন্য একটি বিশেষ একক ব্যবহৃত হয় যার নাম ইলেকট্রন ভোল্ট(eV)। সত্যিকার অর্থে, ইলেকট্রন ভোল্ট ভরের কোন একক নয়। এটি শক্তি পরিমাপের একক। এক ভোল্ট বৈদ্যুতিক বিভবের (চাপের) মধ্য দিয়ে একটি ইলেকট্রনকে সরাতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয় তাই ইলেকট্রন ভোল্ট।
ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তির একটি অতিকায় ক্ষুদ্র একক। এটি এতই ছোট যে কেবল একটি ক্ষুদ্রকায় প্রোটনের ভরের সমপরিমাণ শক্তিকে এই এককে প্রকাশ করলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১০০ কোটি ইলেকট্রন ভোল্ট (১ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)!
প্রোটন আর নিউট্রনের ভর প্রায় সমান। ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের ভরের প্রায় ১৮০০ ভাগের এক ভাগ যার মান প্রায় ৫,০০,০০০ ইলেকট্রন ভোল্ট। সে তুলনায় হিগস বোসনের ভর প্রায় ২৫০ গুণ (১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)।
আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক ছাড়াও আরও বেশ কিছু কণিকা রয়েছে, যেগুলো প্রোটন আর নিউট্রনের ভিতরে আবদ্ধ থাকে। এজন্য এদের ভর নির্ণয় বেশ ঝামেলাপূর্ণ কাজ। আমাদের ধারণা, আপ কোয়ার্কের ভর মোটামুটিভাবে ২০ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্ট, অর্থাৎ, ইলেকট্রনের ভরের প্রায় ৪ গুণ।
অপরদিকে ডাউন কোয়ার্কের ভর প্রায় ৫০ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্ট। সেই তুলনায় নিউট্রিনো বেশ হালকা; এক ইলেকট্রন ভোল্টের ১০০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ!
পদার্থ-প্রতিপদার্থ
গত শতকের ২০-এর দশকের কথা। সে সময় অনেকেই ইলেকট্রনের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন বৃটিশ পদার্থবিদ পল ডির্যাক। তিনি একটি সমীকরণের খোঁজ পেলেন। দেখা গেল, ইলেকট্রনের গতিবিধি বোঝার ক্ষেত্রে এই সমীকরণ বেশ কাজে দিচ্ছে।
তার নাম অনুসারে এই সমীকরণকে ডির্যাক সমীকরণ বলা হয়। সমীরকণটির আকার খুব একটা সহজ নয় বলে এখানে উল্লেখ করা হল না। ইলেকট্রনের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেও ডির্যাকের এই সমীকরণ একটি অন্য রকম ধাঁধার জন্ম দিল। ডির্যাকের সমীকরণ সমাধান করলে দুইটি উত্তর পাওয়া যায়।
একটি সমাধান ইলেকট্রনের আচরণকে ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু অপর সমাধানটি ইলেকট্রনের মতই কাল্পনিক(!) কোন কণিকার দিকে ইঙ্গিত করে যার ভর আর স্পিন ইলেকট্রনের মতই, শুধু এর চার্জ ইলেকট্রনের চার্জের বিপরীত। অর্থাৎ, ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জিত কণা।
কিন্তু পল ডির্যাকের সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধান মতে দেখা গেল, এই নতুন তাত্ত্বিক কণাটি ধণাত্মক চার্জিত। ১৯২৮ সালে যখন ডির্যাক তার সমীকরণটি প্রদান করলেন তখন পর্যন্ত এমন কোন কণিকার সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। একারণে ডির্যাকের সমীকরণ নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি।
প্রকৃতপক্ষে, ডির্যাকের এই তাত্ত্বিক কণা প্রতিপদার্থের (অ্যান্টিম্যাটার) ইঙ্গিত দিচ্ছিল! এমন কোন কণা যে থাকতে পারে– ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এমন বিশ্বাস কারও ছিল না। ১৯৩২ সালে কার্ল এন্ডারসন নামের একজন এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিদ প্রথমবারের মত অ্যান্টিম্যাটার খুঁজে বের করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন।
তিনি যে প্রতিকণিকার (Antiparticle) সন্ধান দেন সেটিই ডির্যাকের সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধান থেকে প্রাপ্ত ‘তাত্ত্বিক কণিকা’। এর মধ্য দিয়ে ডির্যাকের সমীকরণের প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। ইলেক্ট্রনের এই প্রতিকণার নাম দেয়া হল পজিট্রন।
তবে সব কণারই যে প্রতিকণা থাকবে, তেমনটা নয়। যেমন- ফোটন ও গ্র্যাভিটনের প্রতিকণা নেই। যেসব কণার প্রতিকণা থাকে (যেমন- ইলেকট্রন বা ফার্মিওন) তাদের কোন না কোন বৈশিষ্ট্যসূচক সংখ্যামান খুঁজে পাওয়া যাবে, যার মান কণা-প্রতিকণা উভয়ের জন্য একই (যেমন- বৈদ্যুতিক চার্জ বা ফার্মিওন সংখ্যা)। প্রতিপদার্থের মান হয় পদার্থের মানের ঠিক উলটো।
প্রোটন ও নিউট্রন, নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে বলে এদের সমন্বিত নাম নিউক্লিওন। এদের কেউই মৌলিক কণা নয়। এরা কোয়ার্ক নামক আরও ছোট কণিকার সমন্বয়ে গঠিত। নিউক্লিওন দুইটি আলাদা কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি হয়। ঐতিহাসিক কারণে এদের নাম দেয়া হয়েছে আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক।
প্রোটনের চার্জ +১। অপরদিকে নিউট্রনের চার্জ ০। ইলেকট্রনের চার্জ -১। কোয়ার্ক মডেল অনুসারে, প্রোটনে ২টি আপ কোয়ার্ক আছে যাদের প্রত্যেকের চার্জ +২/৩ এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক আছে যার চার্জ -১/৩। অর্থাৎ প্রোটনের মোট চার্জ +২/৩ + ২/৩ – ১/৩ = +১।
কোয়ার্ক একা থাকতে খুব একটা পছন্দ করে না। সবল নিউক্লিয় বলবাহী গ্লুওন কোয়ার্ককে শক্তিশালী কণার মধ্যে আটকে রাখে। কোয়ার্কের চার্জকে মৌলিক তিনটি বর্ণের নামানুসারে ভাগ করা যায়। বলে রাখা ভাল, আমাদের পরিচিত বর্ণের সাথে এই বর্ণের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই।
লেপটন আর গেজ বোসনের কোন বর্ণ নেই। অপরদিকে, কোয়ার্ক লাল (red), সবুজ (green) কিংবা নীল(blue) এই তিন বর্ণের হতে পারে। অ্যান্টিকোয়ার্কগুলো অ্যান্টিরেড (cyan), অ্যান্টিগ্রিন (magenta) কিংবা অ্যান্টিব্লু (yellow) এই তিন বর্ণের হতে পারে।
বর্ণের নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে এমন বিভ্রান্তিকর নাম দেয়ার করার কারণে রিচার্ড ফাইনম্যান তার সহকর্মীদের “Idiot Physicist” উপাধি দিয়েছিলেন! মজার বিষয় হল, কোয়ার্কগুলো সব সময় বর্ণহীন (বা সাদা) অবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এদের ৩টি একত্রে দল বেঁধে থাকলে তাদের ব্যারিয়ন বলে।
যেমন– একটি লাল, একটি সবুজ অথবা একটি নীল যা প্রোটন ও নিউট্রনে দেখা যায়। আবার, একটি কোয়ার্ক ও একটি অ্যান্টিকোয়ার্ক একত্রে থাকতে পারে। যেমন– মেসন কণা একটি রেড ও একটি অ্যান্টি রেড কোয়ার্ক নিয়ে গঠিত। কোয়ার্কগুলোকে এমন রঙের সাথে তুলনা করার আসল মজাটা এখানেই।
কণাদের মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
একটি নিউট্রনকে পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে পৃথক করে নিউক্লিয়াস কাছে কোথাও শূন্যস্থানে রেখে দিলে এটি গড়ে প্রায় ১০ মিনিট পর ভাঙতে আরম্ভ করবে। কারণ, নিউট্রন সুস্থিত কোন কণা নয়। নিউক্লিয়াসের বাইরে নিউট্রনকে রেখে দিলে এটি ভেঙে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন ও একটি অ্যান্টিনিউট্রিনো গঠন করবে।
একটি কণার গঠন পরিবর্তিত হয়ে অন্য কণায় পরিণত হলে, বুঝতে হবে, এখানে অবশ্যই কোন না কোন বল ক্রিয়া করছে। তড়িৎচৌম্বক বল, মহাকর্ষ কিংবা সবল নিউক্লয় বল কোনটিই কণার পরিচয় বদলে দিতে পারে না। এরা কেবল কণাগুলোকে এদিক-সেদিক থেকে একটু ধাক্কা দিতে পারে, এর বেশি নয়।
তাহলে কণাকে পালটে দেয়ার জন্য দায়ী কে? উত্তর হল দুর্বল নিউক্লিয় বল। একটি নিউট্রন যখন ভেঙে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন ও একটি অ্যান্টিনিউট্রিনোতে পরিবর্তিত হয়, তখন একটি আপ কোয়ার্ক পরিবর্তিত হয়ে ডাউন কোয়ার্কে পরিণত হয়। এই পরিবর্তনের পিছনে নাটের গুরু হল দুর্বল নিউক্লিয় বল।
দুর্বল হলে কী হবে, প্রকৃতিতে যত বল আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে গোলমেলে হল দুর্বল নিউক্লিয় বল। এই গোলমেলে আচরণের পিছনে রয়েছে রহস্যময় হিগস বোসনের প্রভাব। দুর্বল নিউক্লিয় বলবাহী বোসনগুলো তিন ধরনের হয়। Z বোসন চার্জের দিক থেকে নিরপেক্ষ যার ভর ৯১ বিলিয়ন eV (electron volt)।
W বোসন ২ ধরনের। ধনাত্মক চার্জিত W+ এবং ঋণাত্মক চার্জিত W–। এদের প্রত্যেকের ভর ৮০ বিলিয়ন eV। একটি কণাকে আরেকটি কণায় রুপান্তরের পিছনে দায়ী W বোসন। আপ কোয়ার্ক- যার চার্জ +২/৩ ধনাত্মক চার্জিত W বোসন নিঃসরণ করে ১/৩ চার্জযুক্ত ডাউন কোয়ার্কে পরিণত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে সর্বমোট বৈদ্যুতিক চার্জের পরিমাণ একই থাকে।
W ও Z বোসন খুব দ্রুত ভেঙে যায়। একারণে কণাপদার্থবিদ্যার যে কোন পরিক্ষাগারে এদের কখনই দেখা যায় না। কিন্তু এদের আদান-প্রদানের ফলে নতুন যে কণাগুলো তৈরি হয় সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আধুনিক কণা পদার্থবিদ্যায় এদের বিচরণ সর্বত্র। একই কথা প্রযোজ্য হিগস বোসনের ক্ষেত্রেও।
১৯৬৩ সালে কার্ল অ্যান্ডারসন আরেক ধরনের কণার সন্ধান পান যার ভর ইলেকট্রনের ভরের থেকে বেশি কিন্তু চার্জ ইলেকট্রনের সমান। তিনি অনুমান করেন, এই নতুন আবিষ্কৃত কণা – যাকে আমরা বর্তমানে মিউওন বলে জানি – ইলেকট্রনের মতই তবে ইষৎ ভারী।
মিউওন আবিষ্কারেরে মধ্য দিয়ে কণাগুলোর কর্মকৌশলের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। আমরা বুঝতে পারলাম, আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো– এই চারটি ফার্মিওন একই পরিবার কিংবা একই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।
ফার্মিওনের সব মিলে তিনটি ফ্যামিলি আছে। প্রতিটি ফ্যামিলিতে দুইটি কোয়ার্ক এবং দুইটি লেপটন আছে। দুইটি লেপটনের মধ্যে একটি চার্জিত, অপরটি নিরপেক্ষ (নিউট্রিনো)। ইলেকট্রনের আরেকটি নিকটাত্মীয় আছে যার ভর ইলেকট্রনের থেকে একটু বেশি। এর নাম আমরা আগেই জেনেছি- মিউওন।
মিউওনেরও আরেক আত্মীয় হল টাউ(Tau)। এর ভর মিউওন থেকে একটু বেশি। নিউট্রিনোকে এখনকার দিনে ইলেকট্রন নিউট্রিনো নামে ডাকা হয়। কারণ মিউওন নিউট্রিনো এবং টাউ নিউট্রিনো নামে আরও ২টি নিউট্রিনো আছে।
আরও রয়েছে আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক। এর বাইরে কোয়ার্কের মধ্যে আরও মজার দুটি কোয়ার্ক হল– চার্ম (charm) কোয়ার্ক ও স্ট্রেঞ্জ (strange) কোয়ার্ক! কোয়ার্কের মধ্যে আরও রয়েছে টপ (top) কোয়ার্ক ও বটম (bottom) কোয়ার্ক।
কণার স্ট্যান্ডার্ড মডেল যথেষ্ট কার্যকরি হলেও এত এত কণার সমাহার একে কিছুটা হিজিবিজি করেছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এ কারণে অনেকে মনে করেন, এত কণার অস্তিত্ব অন্য কোন রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সেসব রহস্য আমাদের আজও অধরাই রয়ে গেছে।
আমাদের এত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল একটাই; হিগস বোসনকে চেনা। কিন্তু সেটা এ পর্বেও বাকি থেকে গেল। হিগস বোসন মাত্র ক’বছর আগে আবিষ্কার হলেও আমরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই জানতাম যে এমন কিছুর অস্তিত্ত্ব প্রকৃতিতে না থেকেই যায় না! কিন্তু কীভাবে?
সেটা বোঝার জন্য জানতে হবে প্রতিসাম্য বা সিমেট্রি সম্পর্কে। সেটা আপাতত পরবর্তী সংখ্যার জন্য তোলা থাক। আজ এ পর্যন্তই।
[প্রফেসর শন ক্যারোলের একটি লেখা অবলম্বনে]
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৮। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৩
No Comment