।মাহমুদুল হাসান জাবির।
আজ তোমাদের কাছে এই মহাবিশ্ব তৈরির শুরুর ইতিহাস নিয়ে হাজির হলাম। তোমাদের প্রশ্ন জাগতে পারে, এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনটা কী? এর সাথে মহাবিশ্ব তৈরির ইতিহাসের সাথে কী সম্পর্ক?
তবে, চলো গল্পের আসরে বসে যাই। তোমরা নিশ্চয়ই বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে চিনো। যিনি কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইতিকথা সম্বলিত একটি বহুল প্রচলিত থিওরি প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেটা হলো বিগ ব্যাং থিওরি। একে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বও বলা হয়।
বিগ ব্যাং কী? বিগ ব্যাং হলো এক মহা বিস্ফোরণ। আজ থেকে ১৩.৭৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাবিশ্ব অতি ঘন ও উত্তপ্ত অবস্থায় ছিলো। অতঃপর, কোনো একটি বিশেষ মুহূর্তে এই অবস্থা থেকে মহাবিস্ফোরণ ঘটে। এরপর বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টি হয় এবং তা প্রসারিত হতে থাকে।
বিজ্ঞানী এডউইন হাবল প্রথম বলেন- দূরবর্তী ছায়াপথসমূহের বেগ সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এরা পরষ্পর দূরে সরে যাচ্ছে। হাবল যে বিশেষ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তাদের বলা হয় সেফেইড-ভ্যারিয়েবল। সেফেইড-ভ্যারিয়েবলদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সময়ের সাথে সাথে এদের উজ্জ্বলতা ওঠা-নামা করে।
১৯১২ সালের হেনরিয়েটা লেভিট সেফেইড-ভ্যারিয়েবলদের উজ্জ্বলতার সাথে উজ্জ্বলতার স্থায়িত্বের গাণিতিক সম্পর্ক বের করেন। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যদি কোনো সেফেইড-ভ্যারিয়েবলদের উজ্জ্বলতার-স্থায়িত্ব নির্ণয় করা যায় তবে গাণিতিকভাবে ঐ সেফেইড-ভ্যারিয়েবলদের সহজাত উজ্জ্বলতা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব।
এই সহজাত উজ্জ্বলতা এবং পর্যবেক্ষিত উজ্জ্বলতার ব্যবধান থেকে নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব নির্ণয় করা সম্ভব। হাবল এই পদ্ধতিতেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতার ধারণাতে উপনীত হন।
তারমানে বুঝতেই পারছো মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সম্প্রসারণ এতই দ্রুত যে, ছায়াপথসমূহ যত দূরে যাচ্ছে তত দ্রুতই প্রসারিত হচ্ছে। এই প্রসারণ থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে নিশ্চয়ই মহাবিশ্ব কোনো একটি বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে। আর ওই শুরু থেকে বেড়ে এখনো বাড়ছে।
অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো ধারণা করেই করা। কারণ, আমরা তো আর অতীতে ফিরে গিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। তাই বর্তমান প্রেক্ষিতের উপর ভর করে অতীতের ঘটনা বর্ণনা করতে হয়েছে। আর এজন্যই বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। যেমনটি তোমরা তোমাদের বইতে পড়ে থাক। তাই বিজ্ঞানের থিওরি অকাট্য নয়।
চিত্র-১: হেনরিয়েটা লেভিট
এখনও তোমাদের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনটা কী? সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়। তবে তার আগে আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায়। বিগ ব্যাং তত্ত্বানুসারে মহাবিস্ফোরণ ঘটলো। তার আগে কী ছিলো? আর যেসব বস্তু থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটলো, সেসব বস্তুই বা আসলো কোথা থেকে?
আসলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমেই সেসব বস্তুর উৎপত্তি। মহাবিশ্বে পরম শূন্যস্থান বলতে কিছু নেই। যেমন তোমরা একটা খালি স্থান দেখো। সেখানে কিছুই নেই। কিন্তু আসলেই কি কিছু নেই? না সেখানে বায়ুর অণু পরমাণু রয়েছে।
তেমনি বিগ ব্যাং এর পূর্বে যেই খালি স্থান ছিলো অর্থাৎ কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়াম ছিলো। সেখানে কণা প্রতিকণা ছিলো। একেবারেই সম্পূর্ণ শূন্য ছিলো না। সেখানে প্রতি মুহূর্তে কণা প্রতিকণা সৃষ্টি হচ্ছে এবং একে অপরে ঘর্ষণের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার স্থায়িত্ব মাত্র সেকেন্ডের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। এই ঘটনাকেই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলে।
এখন তোমরা প্রশ্ন করতে পারো যে, যদি কণা ধ্বংসই হয়ে যায় তবে বিগ ব্যাং কিভাবে সৃষ্টি হলো? এই যে প্রতি মুহূর্তে কণা তৈরি হচ্ছে এবং পজিটিভ শক্তি নেগেটিভ শক্তি সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো কারণে কিছু কণার পজিটিভ শক্তি ও নেগেটিভ শক্তি ধ্বংস হয় না। আর সেগুলো আস্তে আস্তে বিগ ব্যাং হয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়।
এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন তত্ত্বের ভিত্তি হলো বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এই নীতির মূলকথা হচ্ছে, একই সময়ে কোনো কণার ভরবেগ ও অবস্থান নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায় না। যেকোনো একটি নির্ভুলভাবে মাপতে গেলে অপরটি নির্ভুলভাবে পাওয়া যাবে না।
এর কারণ কী? সেটা হলো কণাকে আলো দিয়ে মাপতে হয়। কণার উপর আলো ফেলা হয়। এখানে আবার আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট বা বড় হতে পারে। যদি বড় হয়, তখন নিখুঁতভাবে অবস্থান মাপা সম্ভব হয় না। সেজন্য ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ফেলতে হয়। আর ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোর শক্তি বেশি।
কারণ, আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে যত ছোট হয়, তার শক্তি তত বেশি হয়। আর যখন কণার অবস্থান নির্ভুলভাবে জানতে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ফেলা হয় তখন আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শক্তি কণাকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে ভরবেগের অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। তোমরা নিশ্চয়ই স্যার ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের এই সুত্রটি বুঝতে পেরেছো।
চিত্র-২: কণার অবস্থান নির্ভুলভাবে জানতে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ফেলা হলেই আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শক্তি কণাকে অস্থির করে তোলে
এবার চলো বিগ ব্যাং ঘটনার পূর্বের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করি। বিগ ব্যাং-এর পূর্বে ছিলো না কোনো স্থান কিংবা কোনো সময়। কারণ, আমরা সময় নিরুপণ করি যখন সূর্য আর পৃথিবী থাকছে। সূর্য ও পৃথিবী নির্দিষ্ট অক্ষে নির্দিষ্ট সময় নিয়ে ঘুরছে। যার কারণেই মূলত সময়ের ধারণা আসে।
একইভাবে সম্পূর্ণ মহাবিশ্বে যত গ্রহ নক্ষত্র আছে। এদের সাপেক্ষতার ভিত্তিতে সময় নিরুপণ করা যায়। এখন কথা হলো যখন এমন চাঁদ, সূর্য, পৃথিবীর মতো কোনো কিছুই ছিলো না, তখন তো সময়েরও প্রশ্ন আসে না। একইভাবে এগুলো যেহেতু ছিলো না তাই স্থানেরও প্রশ্ন আসে না।
তখন শুধুই কণা-প্রতিকণা ছিলো। এরা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব তৈরি করেছে। এসব কণা বিপরীতধর্মী বলপ্রাপ্ত হওয়ায় সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলো। আবার বাকি থাকা কণাগুলো যুক্ত হতে হতে বিগ ব্যাং সৃষ্টি হয়েছিলো।
বিগ ব্যাং ঘটনার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস তো রয়ে গেলো। ইনশাআল্লাহ, আগামী সংখ্যায় তোমাদের নিকট ইনফ্লেশন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবো। আজ এ পর্যন্তই।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৫
No Comment