।নাসিম আহমদে।
বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী/গবেষক, গবেষণা কতগুলো অতুলনীয় বিশেষ শব্দ যেগুলোর জন্যে আমরা আধুনিক বিশ্বে এতোটা সুবিধা নিয়ে বেঁচে আছি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার দ্রুততা এতই বেশি যে, যেন মুহুর্তের মধ্যে আমরা যুগের পরিবর্তন করছি।
ইলেক্ট্রিক্যাল, এনালগ ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তিগুলোই যেখানে আমাদের জন্য দুর্বোধ্য সেখানে এর চেয়ে দ্রুত ও অধিক দক্ষতা সম্পন্ন প্রযুক্তিগুলো যে আমাদের আরও কৌতুহলী করে তুলবে না সেটা বলার হয়তো আর প্রয়োজন নেই।
বিজ্ঞানের নতুন ছাত্ররা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী কিংবা গবেষক। কিন্তু অধিকাংশ সময় তাদের দ্বিধায় পড়তে হয় যে তারা কোন বিশেষ প্রযুক্তি নিয়ে এগোবে। কোন বিশেষ প্রযুক্তিটি তাদের কাছে বিশেষ পছন্দের এবং মজাদার।
বিশেষ সে সকল প্রযুক্তি গুলোর সাত পর্বের ধারাবাহিকের মধ্য থেকে আজ থাকছে ফোটোনিক্স। যাকে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলা হয়।
ফোটোনিক্স কি?
ফোটোনিক্স শব্দটি একটু ভেঙে দেখা যাক, আমরা পাবো ফোটন+ইলেকট্রনিক্স। অর্থাৎ, আলোর ফোটন কণা ও ইলেক্ট্রনিক্স প্রযুক্তির সম্মিলিত নামই হলো ফোটোনিক্স। একটু গুছিয়ে বলতে গেলে ফোটোনিক্স হলো প্রযুক্তির এমন এক শাখা যেখানে আলো-কণার সনাক্তকরণ, পরিবহন, নির্গমন, মডুলেশন, সিগন্যাল প্রক্রিয়াকরণ, সুইচিং, পরিবর্ধন, এবং সেন্সিং ইত্যাদি আলোচনা করা হয়।
চিত্র-১: আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয় ফোটোনিক্স
ইলেক্ট্রনিক্স প্রযুক্তিতে যেমন ভাবে ইলেক্ট্রনের ব্যবহার হয়ে থাকে ঠিক একইভাবে ফোটোনিক্সে ফোটনের ব্যবহার হয়। অর্থাৎ ফোটোনিক্স হলো আলোর কণা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রনিক্স প্রযুক্তি। ফোটন ব্যবহারের সবচেয়ে সুবিধা জনক দিক হলো বিদ্যুৎ তথা ইলেক্ট্রনের চেয়েও এটি দ্রুতগতি সম্পন্ন, সহজ লভ্য এবং অধিক কর্মদক্ষতা সম্পন্ন।
ফোটোনিক্স কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সময়, খরচ বাঁচানোর জন্যই নিত্য নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার করছে বিজ্ঞানীরা। ফোটোনিক্সের চিন্তাভাবনার আবির্ভাব সেখান থেকেই বলা চলে। আমাদের ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, তথ্য আদান-প্রদান ইত্যাদির গতি বাড়ানোই ফোটোনিক্স প্রযুক্তির প্রধান লক্ষ্য।
ইলেক্ট্রিক্যাল কিংবা ইলেক্ট্রনিক কাঁচামাল যেখানে ব্যয়বহুল, ফোটন সেখানে প্রায় মূল্যহীন এবং সহজলভ্য। তবে ফোটোনিক্স প্রযুক্তি নিম্নোক্ত কারণ সমূহের জন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ:-
১। লেজার রশ্মি ওয়েল্ডিং কিংবা ড্রিলিং এর কাজে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধাতু, তন্তু, মানব দেহের টিস্যু, কিংবা বিভিন্ন পদার্থ কাটতে লেজার ব্যবহৃত হয়।
২। ব্যান্ডউইথড বেশি থাকার জন্য রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ও মাইক্রোওয়েভ সিগনালের চেয়ে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান (data transmission) করতে পারে।
৩। অপটিক্যাল ফাইবার আলোর সিগনালকে পাইপ আকারে দ্রুত স্থানান্তর করতে পারে।
৪। আলোর বর্ণালীগত বিশ্লেষণ বিভিন্ন গ্যাস কিংবা কঠিন পদার্থের নেতিবাচক সনাক্তকরণ ও পরিমাপযোগ্যতা সম্পর্কে সুন্দর ধারণা দিতে পারে।
৫। ইমেজিং অর্থাৎ ছবির ডাটাকে দ্রুত ডিজিটাল সিগনালে রুপান্তর করা কিংবা কম্পিউটারসহ সব ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে গণনার কাজ আরও দ্রুততম সময়ে করতে পারে।
তাছাড়া আরও নানাবিধ কারণে ফোটোনিক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই এসব কত দ্রুত উন্নত হচ্ছে। একটা সময় দেখা যাবে যে ইলেক্ট্রনিক বিজ্ঞানও হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। যেমন পাওয়ার সেক্টরটি প্রায় হয়ে গিয়েছে।
অথচ গত ৪০-৫০ বছর আগেও পাওয়ার সেক্টর নিয়ে অনেক আগ্রহ ও জল্পনা-কল্পনা ছিলো। কম্পিউটার প্রযুক্তির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যাবে আমাদের প্রজন্ম যখন ছোট ছিলো তখন কম্পিউটাগুলো ছিল সব ডুয়েল কোরের। অথচ ১০ বছরের ব্যবধানে এখন আমরা সবাই কোর আই-সেভেন ব্যবহার করছি।
ইন্টেলে কর্মরত বিজ্ঞানীরা বলেছে একটা সময় তারা ইলেক্ট্রনিক চিপ ব্যবহার বন্ধ করে দিবে যার পরিবর্তে তারা কি না ফোটোনিক্স প্রযুক্তিতেই ভরসা করবে। বুঝাই যাচ্ছে দিন দিন ইলেক্ট্রনিক্সও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যার জন্য ফোটোনিক্সই এখন বিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
ফোটোনিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগ সমূহ
কোন কোন ক্ষেত্রে ফোটোনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে সেটা জানতে পারলে হয়তো আমাদের আগ্রহ আরেকটু বাড়ব। চলুন সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক সেগুলো।
১। ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রো ও ন্যানো টেকনোলজি: ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইস, মোটরস, ইঞ্জিন, সেমিকন্ডাকটর চিপ, সার্কিটস, কম্পিউটার ইত্যাদি আলো ব্যবহার করে তৈরি করা যায় যাকে ফটোলিথুগ্রাফি বলা হয়।
২। ইনফরমেশন (তথ্য প্রযুক্তি): কোনো একটি অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কে অপটিকস ব্যবহার করে ডাটা স্টোরেজ, ডাটা সুইচ, ডাটা ট্রান্সমিট অত্যন্ত দ্রুত করা যায়।
৩। এরোস্পেস (Aerospace) প্রযুক্তি: লেজার রাডার সিস্টেম ও লেজার আল্টিমিটার (উচ্চতা পরিমাপক) ব্যবহার করে বিমান পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং অবস্থান ইত্যাদি নির্ণয় করা যায়। দিকনির্দেশনার কাজেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।
৪। কৃষিক্ষেত্র: অবলোহিত রশ্মির ইমেজিং কিংবা স্ক্যানিং প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের গুণগত মান পর্যবেক্ষণ করা যায়। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া চিত্র থেকে শস্য ক্ষেতের ক্রপ ইফেক্ট সম্পর্কে জানা যায়। তাছাড়া শস্যের আবাদ ও সেচ কাজেও ফোটোনিক্স প্রয়োগের গবেষণা চলছে।
৫। বায়ো-মেডিসিন: সার্জারিতে ব্যাপকভাবে ফটোডায়নামিক থেরাপি ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে, যার জন্য গবেষকরা তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছে।
উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলো ছাড়াও নির্মাণ ক্ষেত্রে, অল্টারনেটিভ এনার্জি কিংবা গ্রিন এনার্জি উৎপাদনে, রাসায়নিক প্রযুক্তিতে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উৎপাদন, বায়ো-টেকনোলজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অল্প পরিসরে ফোটোনিক্স ব্যবহৃত হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে ফোটোনিক্স প্রয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে বলেই বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়ে এতটা উৎসাহ প্রকাশ করছেন। সুতরাং এটা প্রায় অনুমেয়ই যে, আগামী বিশ্বে ফোটোনিক্সের প্রভাব কতটা গুরূত্বপূর্ণ হবে। বিজ্ঞানীরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে, ২০-২৫ বছর পর হয়তো ইলেক্ট্রনিক্স সম্পূর্ণ পরিপৃক্ত হয়ে যাবে।
সুতরাং বিজ্ঞানের নতুন ছাত্র তথা ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা গবেষণার বিষয় বস্তু হিসেবে যে ফোটোনিক্সকে বেছে নিবে সেটি খুবই পরিষ্কার। ফোটোনিক্স আগামী বিশ্ব শাসন করবে এটাই অনুমেয়। আলো, ফোটন, অপটিক্স, লেজার কাছাকাছি শব্দ যেগুলো হয়তো পরবর্তীতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি প্রযুক্তির প্রধান কাঁচামাল হবে।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বর্ষ ৪। সংখ্যা ৫
No Comment