।তাওহীদ জামান।

তাপ, জ্বালানি ও অক্সিজেন-এই তিনটি বস্তু ছাড়া আগুন কখনও লাগবে না। কিন্তু মজার বিষয় হলো, জ্বলন্ত আগুনে এই তিনটি বস্তুর যে কোনো একটি বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আগুন সাথে­ সাথে নিভে যাবে।

ছোট্ট একটা দেশ আমাদের। তাই বলে দেশ নিয়ে স্বপ্ন কিন্তু ছোট নয় আমাদের। কিন্তু কত শত সুন্দর স্বপ্ন হারিয়ে যায় আগুনে পুড়ে। ভবন তো পোড়ে না, পোড়ে যেন আমাদের এক একটি স্বপ্ন। এক একটি হৃদয়। তোমাদেরও জানা দরকার, কেন, কীভাবে লাগে আগুন। আর আগুন লেগে গেলেই বা কী করবে।

দেশে গড়ে প্রায় আট হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণই গড়ে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়াও ঝরে যায় অসংখ্য মূল্যবান জীবন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বছরজুড়ে  যে অগ্নিকাণ্ড হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটে বছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ শীত ও বসন্তকালে।

ফায়ার সার্ভিসের হিসেব বলছে, ২০১৮ সালে সংঘটিত ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৭ হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ডই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। চুলার আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৯টি, আর সিগারেটের আগুন থেকে ৩ হাজার ১০৮টি।

 দেশে গত ১০ বছরে ছোটবড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৫৯০ জন। এতে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি  অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গত বছর। সর্বশেষ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ২৩ জন এবং ঢাকার চকবাজারে ৬৭ জন নিহত হয়েছে।

অধিকাংশ শিল্প-কারখানা বা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নিরাপত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। একাডেমিক পড়াশোনায় এটা অনেক ক্ষেত্রে পড়ানো হয়, অনেক ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু প্রফেশনাল লাইফে এ সম্পর্কে জানা বেশ জরুরি। বিভিন্ন প্র্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝেই এর ওপর ট্রেনিং-এর আয়োজন করে থাকে।

তিনটি জিনিসের উপস্থিতি আগুন ধরায়। সেগুলো হলো−

ক) পর্যাপ্ত তাপ (Enough heat)

খ) জ্বালানি (Fuel) এবং

গ) অক্সিজেন (Oxygen)।

আর এই তিনটি প্যারামিটার একসঙ্গে একটি ত্রিভুজ তৈরি করে। একে ফায়ার ট্রায়াংগেল (Fire triangle) বলা হয়।

এই তিনটি বস্তুর কোনো একটি ছাড়া আগুন কখনো লাগবে না বা সৃষ্টি হবে না অথবা কেউই আগুন লাগাতে পারবে না। কেবল যখনই একসাথে তিনটি বস্তু সম্মিলিত হবেকেবল তখনি আগুন উত্পন্ন হবে। মজার বিষয় হলো, জ্বলন্ত আগুনে এই তিনটি বস্তুর মধ্যে যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আগুন সাথে­ সাথে নিভে যাবে।

বিভিন্ন জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে আগুনের প্রকার :

ক) সাধারণ দাহ্য : এগুলো সাধারণত কাঠ, প্লাস্টিক, কাপড়, কাগজ জাতীয় পদার্থ থেকে উদ্ভূত আগুন। এদেরকে “A Class” ফায়ারও বলে।

খ) দাহ্য তরল : জ্বালানি তেল (পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন ইত্যাদি) সাধারণ দাহ্য দ্রাবক সমূহ। এদেরকে “B Class” ফায়ারও বলে।

গ) দাহ্য গ্যাস : মিথেন, প্রোপেন, হাইড্রোজেন, অ্যাসিটিলিন বা প্রাকৃতিক গ্যস। এদেরকে “C Class” ফায়ারও বলে।

ঘ) চার্জিত ইলেক্‌ট্রিক্যাল সার্কিট : যুক্তরাষ্ট্রে এগুলোকে “C Class” ক্যাটাগরিতে রাখা হয়।

ঙ) ধাতব দাহ্য : এদেরকে “D Class” ফায়ারও বলে।

চ) রান্নার তেল ও চর্বি : এদেরকে “F Class” ফায়ারও বলে

আগুন লাগলে করণীয় :

স্বয়ং ফায়ার শব্দটার মাঝেই খুব সুন্দর একটা নির্দেশিকা আছে : FIRE

F= Find

I= Inform

R= Restrict

E= Extinguish

আগুন ধরলে আগে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আগুন লেগেছে, আগুনের উৎস কি? তারপর সবাইকে জানাতে হবে। তারপর একার পক্ষে সম্ভব হলে একাই অথবা দক্ষ জনবল সঙ্গে নিয়ে আগুনের ‍উৎসটিকে আলাদা করে ফেলতে হবে। তবে অবশ্যই একা ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। অতঃপর আগুন নিভানোর কাজ শুরু করতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের আগুনের জন্য অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা

ক) সাধারণত পানি, বালি দিয়ে A Class ফায়ার নিয়ন্ত্রণ করা বা নেভানো যায়।

খ) ‘ড্রাই পাউডার ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ দিয়ে  A class, B Class এবং C Class আগুন নেভানো হয়। এজন্য একে ABC ড্রাই পাউডারও বলে।

গ) ফোম জাতীয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার A class এবং B Class এর আগুন নেভানো হয়। 

ঘ) কার্বন ডাই-অক্সাইড ফায়ার এক্সটিংগুইশার  দিয়ে B Class এবং চার্জিত ইলেক্টিক্যাল সার্কিটের আগুন নেভানো হয়।

পানি ছিটিয়ে দাহ্যবস্তুর তাপমাত্রা কমিয়ে অগ্নি নির্বাপণ করা যায় অথবা কেমিক্যাল ব্যবহার করে আগুনের ওপর কৃত্রিম স্তর সৃষ্টি করে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা প্রদান করে অগ্নি নির্বাপণ করা যায় কিংবা দাহ্যবস্তুকে অপসারণ করে অগ্নি নির্বাপণ করা যায়। তবে আগুনের ধরনের ওপর নির্ভর করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অগ্নি নির্বাপণের পদ্ধতিকে দু’টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়-

(১) পানি প্রয়োগ করে অগ্নি নির্বাপণ : পাত্র দিয়ে পানি বহন ও ছিটিয়ে অগ্নি নির্বাপণের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নব ঘুরিয়ে আগুনের উৎপত্তিস্থলে প্রবলবেগে পানি স্প্রে করা হয়। যেমন- ফায়ার হাইড্রেন্ট বা স্প্রিংকলার সিস্টেম।

অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল− যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস− যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

যে কোন জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোন দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই।

এমনকি পাশের দেশ ভারতের কলকাতাকেও এর আওতায় আনা হয় সেই ইংরেজ আমলেই। যেখানে কলকাতাকে মাত্র একটি নদী আর ঢাকাকে বেষ্টন করে আছে চারটি নদী। কিন্তু অপরিকল্পিত এ ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

অথচ ফায়ার হাইড্রেন্ট মূলত স্থাপন করা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকায় ও যেসব রাস্তায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সহজেই প্রবেশ করতে পারে না। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।

ফায়ার হাইড্রেন্ট কীভাবে কাজ করে?

খুব সহজে বলতে গেলে ফায়ার হাইড্রেন্ট যুক্ত থাকে একটি বা একাধিক জলাধারের সঙ্গে। আর এর সঙ্গে থাকে অতি শক্তিশালী পাম্প। ব্যবহারের সময় এ পাম্প চালু হয়ে যায় এবং জোরে এর মুখ দিয়ে পানি নির্গত হতে থাকে। চালু হওয়া থেকে পানি বের হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগে। একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে মিনিটে ১৫০০ থেকে ৫০০০ গ্যালন পানি বের হয়।

সাধারণত, ফায়ার হাইড্রেন্টসমূহ শহরের রাস্তার প্রতিচ্ছেদের পাশে বসানো হয়। ফায়ার হাইড্রেন্টের জলাধারগুলো প্রাকৃতিক পানির উৎস যেমন : নদী, লেকের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এগুলোর অবস্থান পানির উৎস থেকে নীচুতে থাকে− যাতে করে পানির সম-উচ্চশীলতার কারণে উৎস থেকে জলাধারে আপনা-আপনি পানি চলে যায়− যার কারণে ফায়ার হাইড্রেন্টের পানির সরবারহ যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই থাকে।

ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে হোসপাইপের সাহায্যে আগুনের উৎসের কাছে পানি নিয়ে যাওয়া যায়। অধিক নিরাপত্তার কারণে বহুতল ভবনের প্রতি ফ্লোরে সিঁড়ির পার্শ্বে বা নির্দিষ্ট স্থানে দেয়ালে হোস পাইপ সংযুক্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা থাকতে হয়− যাতে প্রয়োজনে হোস পাইপ ভবনের যে কোনো প্রান্ত পর্যন্ত সহজে বহন করা যায়।

এতে করে বড় ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনায় হোস পাইপের নব ঘুরিয়ে প্রবল বেগে পানি স্প্রে করে অগ্নি নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। এ দিকে ৪০০ ফিটের বেশি দূরত্বে ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে হোস পাইপে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ পাওয়া যায় না।

২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার জনসংখ্যার একটি কমিউনিটির জন্য ২০০ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করলে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ৫০০০ গ্যালন পানি প্রবাহ পাওয়া যাবে। যেখানে ৩০০ ফুট দূরত্বের ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য প্রতি মিনিটে ১০০০ গ্যালন পানি প্রবাহ পাওয়া সম্ভব।

উন্নত বিশ্বের আদলে অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় দ্রুত পানি সরবরাহ করতে চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি পয়েন্টে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। সারা শহর জুড়ে প্রধান সড়ক পয়েন্টে আরো ১০০টির ওপরে এসব অটোমেটিক আগুন নেভানোর পানির ব্যবস্থাপনা বসানোর কাজ চলমান।

(২) রাসায়নিক ব্যবহার করে অগ্নি নির্বাপণ : ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার (DPC), কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), কেমিক্যাল ফোম ব্যবহার হচ্ছে অগ্নি নির্বাপণের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই রাসায়নিকগুলো ফায়ার এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডারের ভেতরে কমপ্রেসড্ অবস্থায় থাকে।

প্রয়োজনের সময় হাতল চেপে আগুনের ওপর প্রয়োগ করে সহজেই অগ্নি নির্বাপণ করা যায়। প্রাথমিক অবস্থাতেই আগুন নেভানোর প্রয়োজনে প্রত্যেক ব্যক্তিরই এই ফায়ার এক্সটিংগুইশার (Fire Extinguisher) ব্যবহার পদ্ধতি জেনে রাখা আবশ্যক।

অগ্নি নির্বাপক বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার :

সাধারণত কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), ড্রাই পাওডার (Dry Powder) বা ফোম (Foam) এই তিন প্রকারের ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করা হয়।

ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারের নিয়মPASS :

P- Pull the Pin. এক্সটিংগুইশারের মুখের পিনটি টেনে খোল।

A- Aim Low at the base of fire. এক্সটিংগুইশারের মুখ বা নজোলটাকে আগুনের গোড়ার দিকে তাক করো।

S- Squeeze the lever above the handle. এক্সটিংগুইশারের হাতলের লিভারটিকে চাপ দাও।

S- Sweep from side to side. বাতাসের গতি লক্ষ করে নজোলটাকে ঠিকমত ঘুরিয়ে আগুন নেভাও। 

চিত্র ৫ : ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারের নিয়ম

ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারে সতর্কতা :

সময়মত এ যন্ত্রটিকে ব্যবহার করা গেলে অনেক সময়ই বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতাও অবলম্বন করতে হবে। যেমন-

ক) ফায়ার এক্সটিংগুইশার ফ্লোর থেকে অন্তত পাঁচ ফুট ওপরে সেট করতে হবে− যাতে সেটি বাচ্চাদের নাগালের বাইরে থাকে।

খ) ফায়ার এক্সটিংগুইশার কখনো তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না।

গ) মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই সেটিকে পুনরায় সচল এবং কার্যক্ষম করতে হবে।

ঘ) ফায়ার এক্সটিংগুইশার সবসময় বাতাসের অনুকূলে থেকে প্রয়োগ করতে হয়− যাতে কেমিক্যাল পাউডার বা গ্যাস বা ফোম উড়ে এসে নিজের গায়ে না পড়ে। আগুনের উৎপত্তিস্থলের সর্বোচ্চ ২ মিটার দূর থেকে ফায়ার এক্সটিংগুইশার প্রয়োগ করতে হয়।

ঙ) কার্বন ডাই-অক্সাইড টাইপ এক্সটিংগুইশার প্রয়োগ করা হলে আগুন নিভুক বা না নিভুক, ঘটনাস্থলে বেশি সময় অপেক্ষা করা যাবে না। কখনোই বাতাসের বিপরীতেও থাকা যাবে না। নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড খুব তাড়াতাড়ি আশেপাশে অবস্থানকারী ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।

চ) উন্মুক্ত স্থানে বা ধাবমান বাতাসযুক্ত স্থানে কার্বন ডাই-অক্সাইড টাইপ এক্সটিংগুইশার প্রয়োগ খুব একটা কার্যকর হয় না। এক্ষেত্রে বালি বা পানি (প্রয়োজন অনুযায়ী) ব্যবহারই উত্তম।

বাজারে বিভিন্ন ফায়ার এক্সটিংগুইশার :

প্রতিটি ফায়ার এক্সটিংগুইশারের গায়ে লেখা থাকে তাতে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে। সিলিন্ডারের গায়ের রং দেখেও বুঝা যায় তা কী ধরনের এক্সটিংগুইশার। যেমন : লাল রং হচ্ছে ওয়াটার টাইপ, ক্রিম কালার হচ্ছে ফোম টাইপ, কালো রং হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড টাইপ এবং নীল রঙের এক্সটিংগুইশার হচ্ছে পাউডার টাইপ।

ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলোকে সাধারণত এ, বি, সি ক্লাসে ভাগ করা হয়− যা নির্দেশ করে যে কোন ধরনের আগুনে এটিকে ব্যবহার করা যাবে। প্রতিটি যন্ত্রের গায়েই এর ক্লাস উল্লেখ করা থাকে। বর্তমানে অনেক ফায়ার এক্সটিংগুইশারই রয়েছে যেগুলো এ বি সি ক্লাস। অর্থাৎ তিনটি ক্লাসের আগুনেই এগুলোকে ব্যবহার করা যাবে।

এ ক্লাস : এ ক্লাসের ফায়ার এক্সটিংগুইশারকে কাঠ, কাগজ কিংবা কাপড়-চোপড় এ লাগা আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে।

বি ক্লাস : বি ক্লাসের এক্সটিংগুইশারকে গ্যাসোলিন কিংবা তেল থেকে সৃষ্ট হওয়া আগুনে ব্যবহার করা যাবে।

সি ক্লাস : সি ক্লাসের এক্সটিংগুইশার বিদ্যুৎ থেকে সৃষ্ট হওয়া আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।

ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেনার ক্ষেত্রে এর সাইজ বিবেচনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বড় এক্সটিংগুইশারগুলো বেশি আগুন নেভানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বেশি ওজন হওয়ার কারণে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কাজেই যতটুকু বড় সম্ভব, যেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে সহজে, সেরকম অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রই স্থাপন করা উচিত।

বাজারে বিভিন্ন সাইজের ফায়ার এক্সটিংগুইশার পাওয়া যায়। যেমন :

১০ পাউন্ড : এগুলো গ্যারেজ কিংবা বাসার নিচের ওয়ার্কশপের জন্য ভালো। যেখানে আগুন খুব তাড়াতাড়ি নজরে আসেনা এবং মোটামুটি বড় আকার ধারণ করে।

৫ পাউন্ড : এই এক্সটিংগুইশারগুলো রান্নাঘর কিংবা লন্ড্রি রুমের জন্য উপযুক্ত।

২ পাউন্ড : দুই পাউন্ডের এক্সটিংগুইশারগুলো সাধারণত গাড়িতে ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন ধরণের আগুনের জন্য বিভিন্ন রকমের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। ভুল রকমের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহারের ফলে আগুন আরও বাড়তে পারে। তাই সঠিক ধরণের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত।
 

ড্রাই কেমিক্যাল ফোম বা পাউডার :

সবচেয়ে জনপ্রিয় অগ্নিনির্বাপন উপাদান হচ্ছে ড্রাই কেমিক্যাল ফোম বা পাউডার− যা সোডিয়াম বাইকার্বনেট (সাধারণ বেকিং সোডা), পটাশিয়াম বাইকার্বনেট অথবা মনো অ্যামোনিয়াম ফসফেট দ্বারা তৈরি। বেকিং সোডা যখন উত্তপ্ত হয় তখন তা অল্প তাপেই (৭০˚ সে.) ভেঙ্গে যায়।

এবং সোডা ভেঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়। সাথে থাকে ইনসুলেটিং ফোম যা একত্রে আগুনকে আবদ্ধ করে ফেলে এবং অক্সিজেন অপসারণ  করে। ফলে খুব দ্রুত আগুন নিভে যায়।

ফায়ার বল :

ঘুপচি জায়গার মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পৌঁছতে পারছেন না দমকলের কর্মীরা। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে এখন থেকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আর চেষ্টাই করবেন না দমকল কর্মীরা। ছুড়বেন একটি বল। তা আগুনের মাঝে পড়তেই ঘটবে ছোট্ট বিস্ফোরণ। মিনিট দশেকের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে পরিস্থিতি।

ফায়ার বল বাস্কেট বলের থেকে বেশ খানিকটা ছোটো, ক্রিকেট বলের থেকে বড়ো। এর মধ্যে রয়েছে ড্রাই মনো অ্যামোনিয়াম ফসফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট। আগুনের মাঝে বলটি ছুড়লেই বিস্ফোরণ ঘটবে। বলের মধ্যে থাকা রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ এবং আগুনের মধ্যে আস্তরণ তৈরি করবে।

অক্সিজেনের অভাবে আগুন দ্রুত নিভে যাবে। তবে এই বল হাত থেকে পড়লে ফাটবে না, শুধু আগুনের কাছাকাছি এলেই ফাটবে। এই বলে কোনো প্রকার সুইচ নেই। কারণ এটি একটি স্বয়ংক্রিয় বল। তাই এটি ব্যবহারে কোনো বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সাধারণত এর ওজন ১.৩ কেজি হয়ে থাকে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ যেকোনো ব্যক্তি এটি ব্যবহার করতে পারেন।

কেবল আগুন লাগার পর ব্যবহার করতে হবে তা নয়। আগুন লাগার পূর্বেও অগ্নিপ্রতিরোধক হিসেবে এটি ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ যেখানেই অগ্নিকাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা আছে, সেখানেই এই বল ব্যবহার করা যাবে। এই বলের আরেকটি বড় সুবিধা হল এটাকে নাড়াচাড়া করলে বা এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও এটি নিজে থেকে কোনো আগুন তৈরি করে না।

তাছাড়া এটি পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে তৈরি হয় বলে এটা মানুষ বা পরিবেশের তেমন কোনো ক্ষতি করে না। তবে এই বলের একটিই অসুবিধা, তা হল- এটা বিস্ফোরিত হবার সময় উচ্চ মাত্রায় শব্দ তৈরি হয়। বলটি বিস্ফোরিত হওয়ার সময় ১২০ ডেসিবেল আওয়াজ উৎপন্ন হয়। চীন এই বলটি তৈরি করে।

স্মোক ডিটেকশন এবং ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম  :

সকল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে একটি অটোমেটিক ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম থাকতে হবে যা সমন্বয় হবে তিনটি ডিভাইসের মাধ্যমে : ক) স্মোক ডিটেক্টর খ) হিট ডিটেক্টর এবং গ) স্প্রিংকলার ওয়াটার ফ্লো ডিভাইস।
যদি স্প্রিংকলার সিস্টেমের মাধ্যমে সকল ফ্লোরকে আওতায় আনা হয়, তবে স্মোক এবং ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেমের প্রয়োজন নেই। ২৩ মিটার বা ৭৫ ফিট উচ্চতার নিচে যে কোনো বিল্ডিং-এ ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম প্রতিস্থাপন করতে হবে। ২৩ মিটার বা ৭৫  ফিট উচ্চতার অধিক হলে স্প্রিংকলার লাগাতে হবে।

স্মোক ডিটেকটর :

একটি সস্তা এবং নির্ভরযোগ্য আগুন আর ধোঁয়া ডিটেক্ট করার গ্যাজেট− যা আমরা স্মোক ডিটেক্টর হিসেবে চিনি। যেটা প্রতি বছর ঘুমিয়ে থাকা লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়। স্মোক ডিটেক্টরের দুটি ধরন আছে। চোখের ন্যায় ডিটেক্টরকে অপটিক্যাল স্মোক ডিটেক্টর বা ফটোসেল স্মোক ডিটেক্টর বা ফটো ইলেকট্রিক ডিটেক্টর বলা হয়।

স্মোক ডিটেক্টর আলোর সেন্সরের ওপর কাজ করে। যেকোনো সাধারণ ফটো বীম ডিটেক্টরে কি ঘটে? দেওয়ালের এক পাশে একটি লাইট লাগানো থাকে (বিশেষ করে লেজার লাইট) এবং ঠিক উল্টো দিকে একটি ফটো ডিটেক্টর লাগানো থাকে− যাতে এটি লাইটটিকে দেখতে পায়।

এখন আপনি যদি এই লাইটের সামনে দিয়ে চলে যান বা কোন এমন বস্তুকে নিয়ে যান যেটি আলোকে ফটো ডিটেক্টরে পৌঁছাতে বাঁধা প্রদান করবে, তাহলে ফটো ডিটেক্টরটি অ্যালার্ম ট্রিগার দাবিয়ে দেয় এবং অ্যালার্ম বেজে উঠে। 

এখন কোনো কারণে ঘরে আগুন লেগে ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে, ধোঁয়া গ্যাজেটটির মধ্যে প্রবেশ করবে এবং ধোঁয়া কণাতে বাঁধা পেয়ে কিছু আলো সমতল ডাট থেকে ঘুরে নিচের লম্বা ডাটের তোলায় থাকা সেন্সরে এসে পড়বে, আর অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আশা করছি আর বুঝতে একটুকুও বাকী নেই!

ফায়ার অ্যালার্ম সার্কিটের বেসিক উপাদান ও গঠনপ্রণালী :

ক) ১টি 10μF ক্যাপাসিটর।
খ) ১টি রেজিস্টেন্স (১ কিলো ওহম)
গ) ১টি ভেরিয়েবল রেজিস্টেন্স (১০ কিলো ওহম)
ঘ) ১টি ট্রানজিস্টর
ঙ) ১টি ডায়োড
চ) ১টি ৬ ভোল্টের বাজার
ছ) থার্মিস্টর অথবা টিউব লাইট স্টার্টারের ভিতরের ছোট লাইট

সার্কিটটিতে মাত্র একটি ট্রানজিস্টর রয়েছে৷ এখানে থার্মিস্টরের পরিবর্তে টিউব লাইটের স্টার্টার এর ভিতরের ছোট লাইট ইউজ করা হয়৷ ওটা সুইচ হিসাবে কাজ করবে৷ যখনি ওই সুইচ এ আগুন বা তাপ লাগবে সাথে সাথেই সার্কিটে থাকা বাজারটি সংকেত দিবে৷

কাজেই উক্ত স্টার্টারটিকে এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে আগুন লাগবার সম্ভাবনা আছে। যেমন : গুদাম, ঘরের ইলেকট্রিক তার বা মেইন সুইচের কাছে।

ফায়ার অ্যালার্ম স্থাপন :

একজন সাপ্লায়ারকে অবশ্যই বি.এন.বি.সি সেকশন-০৪ এর ৪.৪ এবং এন.এফ.পি.এ ৭২-এর গাইড লাইন অনুযায়ী এই সিস্টেম প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্মোক ডিটেকশন এবং ফায়ার অ্যালার্মটি কোনো একটি সম্পূর্ণ বিল্ডিং-এ একসাথে শোনা জেতে হবে− যেন সকল ফ্লোরের লোকজন একসাথে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।

আংশিক নোটিফিকেশন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং উক্ত সিস্টেম থাকলে তা নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী পুনরায় প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্মোক ডিটেকশন এবং ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেমটি নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা থাকতে হবে যেন কোনো ধরনের দূর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস স্টেশন জানতে পারে।

কিন্তু যতদিন তা করা সম্ভব না হবে, একজন নিয়োজিত ব্যক্তি উক্ত যোগাযোগ রক্ষার জন্য নির্ধারণ করা থাকতে হবে। নিয়োজিত ব্যক্তির কর্তব্যস্থলে অবশ্যই সেন্ট্রাল ফায়ার বা স্মোক ইন্ডিকেটর থাকতে হবে। 

মে-জুন ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ১

চারদিকে বিজ্ঞান

টিআইসিআই

পৃথিবী কেন্দ্রের বয়স

ইলেকট্রোপ্লেটিং থেকে ওয়াটার হিটার

পার্কার সোলার প্রোব : সূর্যকে ছোঁয়ার মহাকাব্যিক অভিযান

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চাঁদ

চন্দ্রাভিযান  (পর্ব-১)

পানির অপর নাম তরমুজ!

ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি

অ্যাপেন্ডিক্স কি আসলেই অপ্রয়োজনীয়!

বিটকয়েনের দৌরাত্ন্য

রেডিয়েশন : অসাধারণ ত্যাগের আবিষ্কার

আবরার নাফির ফিজিক্সে রৌপ্য জয়ের গল্প

চুম্বকত্বের আদ্যোপান্ত

চিনে রাখি অসুখগুলি

দুরন্ত বাড়ন্ত e

অবলোহিত আলো দেখতে চাও?

মস্তিষ্ক দখল

মহাবিশ্বের স্ফীতি

মাটির ভুবনে

তোমাদের প্রশ্ন আমাদের উত্তর

কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন