হাসিবুর রহমান

মানব সভ্যতা ঠিক যতটা প্রাচীন তার উন্নতির ধারা ঠিক ততটাও প্রাচীন নয়। আর এই উন্নয়নের আদ্যোপান্ত  জুড়ে আছে কিছু কৌতূহলী মানুষের হাজারো প্রশ্নের ওষ্ঠাগত চাহনিরা। তারই ফলস্বরূপ প্রশ্ন করাকে এখন আশীর্বাদের সাথে তুলনা করা হয়।

যাহোক, তেমনি একটি প্রশ্নই আজকের এই আলোচনার হেতু। প্রশ্নটি আমার মানসপটে কিভাবে উত্থাপিত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেই মূল আলোচনায় চলে যাবো। কিছুকাল পূর্বেও আমরা গুটিকয়েক বন্ধু কোনো এক বাসার ছাদে বিকেল বেলাটা অলস আড্ডায় কাটাতাম।

আলোচনা হতো বিভিন্ন বিষয়ে। আর যে কোনো বিষয়েই আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞানকে কল্পনার সাথে মিশিয়ে অত্যধিক সুচিন্তিত মতামত জাহির করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতাম না।

সেই মজলিসেই একটি প্রশ্ন একদিন অনাহূত ভাবে উত্থাপিত হয়ে নিদারুণ ভাবে আমাদের নিপীড়ন করেছিলো, প্রশ্নটি ছিলো মহাবিশ্বের আকৃতি সংক্রান্ত। সেই সময়ে আমাদের ছোট্ট চাহনিতে নিদারুণ তোলপাড় সৃষ্টিকারী সেই প্রশ্নটি নিয়েই আজকের এই নিবেদন।

আচ্ছা আমরা যখন কোনো কিছুর আকৃতি নির্ণয় করতে চাই তবে সাধারণত প্রথমে কোন চিন্তাটা আমাদের মাথায় আসে? ধরুন আপনাকে বলা হল আপনি যে বিল্ডিং এ থাকেন তার আকৃতি নির্ণয় করতে কিংবা বলা হলো পৃথিবীর আকৃতি নির্ণয় করতে।

উভয়ক্ষেত্রেই প্রথমে আপনার কি এটা মনে হবে না, “ইশ! আমি যদি বিল্ডিং বা পৃথিবী থেকে বের হয়ে হয়ে বাইরে থেকে একে দেখতে পারতাম তবে তো এক নিমেষেই আমি এর আকৃতি বলে দিতে পারতাম!”

আচ্ছা, এই চিন্তাই যদি আমরা মহাবিশ্বের আকৃতি নির্ণয়ে খাটাতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই এই মহাশূন্য থেকে বের হয়ে বাইরে যেতে হবে। সোজা কথায় এর কিনারা বা এজ (The Edge Of Universe) খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু এই মহাবিশ্বের বিশালতা এতই যে আমরা এখনো এর কোনো কিনারা খুঁজে পাইনি এবং আদৌ পাবো কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহের দাবীদার।

চিত্র-১ : মহাবিশ্বের কি আসলেই কোনো প্রান্ত আছে?

আচ্ছা তাহলে কিভাবে আমরা  মহাবিশ্বের বা মহাশূন্যের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি? প্রথমত আমরা আমাদের কতিপয় ধারণার কিছু সংস্করণ করবো। মূলত আমরা স্পেস বা মহাশূন্যকে যেভাবে জানি সেই ধারণাকেই কিছুটা অন্যরকমভাবে দেখবো।

স্পেস বা এম্পটিনেস অথবা মহাশূন্য একে আমরা ডায়নামিক বা পরিবর্তনশীল ফিজিক্যাল বডি বা বস্তুর ন্যয় চিন্তা করবো। অর্থাৎ, এই মহাশূন্য তার আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে (Space can bend )। সেই আকৃতি পরিবর্তনটা আসলে কি রুপ? বা কিসের প্রভাবে হয়? এরকম অনেক প্রশ্নই এখন আমাদের মাথায় উঁকি দিবে।

প্রথমত আমরা দেখবো কিসের প্রভাবে মহাশূন্য তার আকৃতি পরিবর্তন করে। উত্তর হচ্ছে ভর এবং শক্তি এই দুইয়ের প্রভাবে মহাশূন্যের আকৃতি পরিবর্তন হয়।

 

ওপরের চিত্র (২.১, ২.২) অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ভরের প্রভাবে মহাশূন্য (যাকে কিছুটা জালের মতো চিন্তা করতে পারি) এর কিছু অংশ দেবে গেছে। আমরা যদি একটু বাস্তবিকভাবে চিন্তা করতে চাই তাহলে এভাবে ভাবতে পারি, মশারির ওপর যদি কোন মার্বেল রাখি তবে মার্বেল যেখানে থাকবে সেখানে মশারি কিছুটা নিচের দিকে দেবে থাকবে।

অর্থাৎ মহাশূন্যের আকৃতির ওপর ভরের প্রভাব সুস্পষ্ট। শক্তির প্রভাব বুঝার সুবিধার্থে আমরা চিন্তা করবো ঠিক এই মুহুর্তেই কোনো একটি শক্তিশালী মহাকাশযান হঠাৎই কোনো এক কৃষ্ণগহ্বরের শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বলের আওতায় পড়ে গেছে।

যেহেতু মহাকাশযানটি যথেষ্ট শক্তিশালী ইঞ্জিনে নির্মিত তাই সে পুরোপুরি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত না হলেও তার গতিপথ হতে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হবে। অর্থাৎ নিচের চিত্র-৩ অনুযায়ী একটি বক্রপথ সৃষ্টি করবে ।

                                                  

চিত্র-৩

ঠিক তেমনি ভাবে মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে স্পেস বা মহাশূন্য বেঁকে যায়। তাহলে শক্তি এবং ভর উভয়ের প্রভাবে মহাশূন্য যে বেঁকে যায় সে সম্পর্কে আমরা কিছুটা জানলাম! আর হ্যাঁ! এই কথা যে আমি হঠাৎ করে বললাম আর হুট করে হয়ে গেলো এমনটা একদমই নয়! বরঞ্চ এটি হচ্ছে জেনারেল রিলেটিভিটির কথা!

মোদ্দা কথা হচ্ছে, স্পেস বা মহাশূন্য বাঁকতে পারে– যাকে আমরা জ্যামিতির ভাষায় বক্রতা (Curvature) বলে থাকি। তাহলে এই বক্রতা কেমন হতে পারে? বক্রতা বা কার্ভেচারকে আপেক্ষিকভাবে তিন ভাগ করা যায় যথাক্রমে-  

১. ফ্ল্যাট শেপড (চিত্র-৪.১)

২. পজিটিভ কার্ভড (চিত্র-৪.২)

৩. নেগেটিভ কার্ভড (চিত্র-৪.৩)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা ফ্ল্যাট বা সমতল আর কোনটা পজিটিভ অথবা নেগেটিভ তা আমরা কিভাবে বুঝবো? এই ক্ষেত্রে আমরা এই কার্ভেচারের ওপর তিনটি বিন্দু নিয়ে একটি ত্রিভুজ কল্পনা করবো।

যদি এই ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী হয় তবে যে তলে আমরা বিন্দু তিনটি নিয়েছি তা অবশ্যই ফ্ল্যাট অর্থাৎ আলোচ্য তলটির কোনো বক্রতা নাই। আর যদি ১৮০ ডিগ্রী হতে বড়ো বা ছোটো হয় তবে যথাক্রমে তা পজেটিভ বা নেগেটিভ কার্ভড ।

যদি মহাশূন্য পজিটিভলি কার্ভড হয় তবে তার আকৃতি দেখতে গোলকের মতো হবে! যাকে পটেটো শেপড বলা হয়ে থাকে কিন্তু প্রশ্ন হলো মহাশূন্য পজিটিভ্লি কার্ভড হলো তা গোলকের ন্যয় কেনো হবে? আচ্ছা আমরা জানি পজিটিভ কার্ভেচারে ত্রিভুজের কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রীর বেশি হয়! আমরা এখন আমাদের পৃথিবীর জন্য কার্ভেচার নির্ণয় করবো।

 

 

 

 

চিত্র-৬

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই (চিত্র-৬) D, E, F তিনটি বিন্দুকে নিয়ে ত্রিভুজ আঁকলে তার কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রীর বেশি হবে! অর্থাৎ, গোলকের ন্যয় আমাদের এই পৃথিবীটি অন্য অর্থে পজিটিভ কার্ভড। অপরদিকে নেগেটিভ কার্ভড স্পেস দেখতে (চিত্র-৭) কিছুটা একবার ভাঁজ করা পৃষ্ঠার মতো (2D চিন্তা)।

                                           
চিত্র-৭ (দ্বিমাত্রিক দৃশ্য)

কিন্তু এত কিছুর পরও কিন্তু আমরা এখনো আমাদের মূল প্রশ্নের কোনো কিনারা করতে পারিনি। তাহলে স্পেস কিভাবে কার্ভড? আমরা কিভাবে স্পেস এ তিনটি বিন্দু নিয়ে তাদের কোণের সমষ্টি নির্ণয় করবো যাতে তার কার্ভেচার সম্পর্কে জানতে পারি?

মূলত এই মুহূর্তে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যেভাবেই হোক মহাশূন্যে এক বিশাল ত্রিভুজ আঁকা এবং এর কোণত্রয়ের সমষ্টি নির্ণয় করে দেখা! এই কাজটিই করা হয়েছে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন এর মাধ্যমে, সংক্ষেপে যাকে সিএমবি (CMB/CMBR) বলা হয়।

এই ভারিক্কি নামের পদ্ধতিটির কলাকৌশল আমাদের আলোচ্য বিষয় নয় তাই এ নিয়ে কিছু না বলে আমরা প্রাপ্ত ফলাফলকে বেশি গুরুত্ব দিবো। সিএমবি পদ্ধতিতে দেখা গেছে যে আলোচ্য বিশাল ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি  ১৮০ ডিগ্রীর খুব কাছাকাছি হয়।  

তাহলে অবশেষে কিন্তু আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর পেলাম!! ফ্ল্যাটার্থার মতাবলম্বিরা হয়তো জেনে খুশি হবে যে পৃথিবী ফ্ল্যাট না হলেও এই মহাবিশ্বকে আপাতভাবে ফ্ল্যাটই মনে করা হচ্ছে ।

আমরা মহাবিশ্বের কার্ভেচার নির্ণয়ে অন্য একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারতাম যাকে ক্রিটিক্যাল এনার্জি ডেনসিটি বলা হয়! যাহোক, এটি পাঠকের জন্য উন্মুক্ত রইলো! তবে এই পদ্ধতিও আমাদের একই কথা বলে যে মহাশূন্য বা মহাবিশ্ব ফ্ল্যাট শেপড। তবে এখানে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে “আপাতভাবে” বাক্যাংশটি।

অর্থাৎ, এখনো সন্দেহের পুরোপুরি অবসান হয়নি, কিন্তু কেনো? আচ্ছা পৃথিবী যদিও গোলকাকার কিন্তু কোনো পিঁপড়া যদি কোনো একটা শহরের পরিসীমার সমান করে ত্রিভুজ একে কল্পনা করে যে এই পৃথিবী ফ্ল্যাট তাহলে কি পৃথিবীর প্রকৃত আকার সম্পর্কে ধারণা করা গেলো?  

তেমনি এই মহাবিশ্ব অত্যন্ত বিশাল এবং প্রতিনিয়ত প্রসারণশীল, তাই সিএমবি পদ্ধতি যে পিঁপড়ার উদাহরণের মত হয়ে যায়নি তা নিঃসন্দেহে বলা দুষ্কর।

জুলাই-আগষ্ট ২০১৯। বর্ষ ৫। সংখ্যা ২


https://www.byapon.com/2023/mixed/mesopotemio-science.html

 

তোমাদের প্রশ্ন আমাদের উত্তর

চিনে রেখো ওষুধগুলি

নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় 

জেনেটিক্সের আদ্যোপান্ত

ভিপিএন  কী এবং কেন?  

চিনে রাখি অসুখগুলি

অগ্নি নির্বাপণের কথকতা

অগ্নি নির্বাপণের কথকতা

চারদিকে বিজ্ঞান

টিআইসিআই

পৃথিবী কেন্দ্রের বয়স

ইলেকট্রোপ্লেটিং থেকে ওয়াটার হিটার

পার্কার সোলার প্রোব : সূর্যকে ছোঁয়ার মহাকাব্যিক অভিযান

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চাঁদ

চন্দ্রাভিযান  (পর্ব-১)

পানির অপর নাম তরমুজ!

ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি

অ্যাপেন্ডিক্স কি আসলেই অপ্রয়োজনীয়!

বিটকয়েনের দৌরাত্ন্য

রেডিয়েশন : অসাধারণ ত্যাগের আবিষ্কার

আবরার নাফির ফিজিক্সে রৌপ্য জয়ের গল্প

চুম্বকত্বের আদ্যোপান্ত

চিনে রাখি অসুখগুলি

দুরন্ত বাড়ন্ত e